তসলিমা নাসরিন:দ্য কাশ্মীর ফাইলস ছবিটি যখন দেখছিলাম, আমার ভয় হলো, হলে যদি কোনও মুসলমান দর্শক থাকে, তাহলে হয়তো হলের ভেতরেই তাকে পেটাবে হিন্দুরা। আমার ভয় হলো, এই ছবি হিন্দুদের উত্তেজিত করবে, ক্রোধান্বিত করবে, প্রচণ্ড মুসলিম-বিদ্বেষ তৈরি করবে। কাশ্মীরের হিন্দুদের ওপর কাশ্মীরি মুসলমানদের অত্যাচারের চিত্র দেখানো হয়েছে ছবিটিতে। একবার নয়, বারবার। ইহুদিদের বিরুদ্ধে নাৎসি বাহিনীর নৃশংসতার কথা সকলেই জানে। কিন্তু কাশ্মীরি পণ্ডিত বা কাশ্মীরি হিন্দুদের বিরুদ্ধে কাশ্মীরি মুসলমানদের অত্যাচারের কাহিনী দুনিয়ার বেশি লোক জানে না। ছবি দেখতে দেখতে দর্শকদের আর্তস্বর শুনেছি।
যা দেখানো হয়েছে দ্য কাশ্মীর ফাইলসে, তা যদি সত্যি হয়, কোনও অর্ধ-সত্য না থাকে গল্পে, যদি অতিরঞ্জিত না হয় বর্ণনা, তাহলে বলবো কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ওপর অত্যন্ত অন্যায় হয়েছে, কাশ্মীরে বাস করার জন্য নি-িদ্র নিরাপত্তা তাদের অচিরে পাওয়া উচিত। এই ছবি, আগেই বলেছি, হিন্দু দর্শকদের মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষ বাড়াতে পারে। মুসলিমরা তাদের হিন্দু-বিদ্বেষ নিয়ে যত দূর যেতে পারে, হিন্দুরা তাদের মুসলিম-বিদ্বেষ নিয়ে তত দূর কি যেতে পারে? ভায়োলেন্স কে কার চেয়ে বেশি পারে? দেশভাগের সময় কী করে হিন্দু মুসলমান একে অপরকে কচুকাটা করেছে, আমরা সব গল্প শুনেছি, পড়েছি, তথ্যচিত্রও দেখেছি। পরস্পরের প্রতি তাদের ঘৃণা এত বেশি ছিল যে, ১০ লক্ষ লোককে জীবন দিতে হয়েছিল। হিন্দুরা ক’টা মুসলমান মেরেছিল, মুসলমানরা ক’টা হিন্দু মেরেছিল তার হিসেব আমার কাছে নেই।
শুধু মুসলমান নয়, সন্ত্রাস হিন্দুরাও জানে, তারপরও গোপনে বিশ্বাস জন্ম নেয় যে হিন্দুরা মুসলিম নিধন করবে না। মুসলিমদের মধ্যে অনেকে নানা রাজনৈতিক কারণে সন্ত্রাসী হয়ে উঠেছে, কিন্তু হিন্দুদের মধ্যে সন্ত্রাসীর সংখ্যা নিতান্তই কম। কোনও এক কালে কিছু মুসলিম অন্যায় করেছিল, তার মানে এই নয় যে সকল মুসলিম অপরাধী। অপরাধী এবং নিরপরাধের মধ্যে হিন্দুরা পার্থক্য করবে। নিরপরাধ কারওর গায়ে হাত তুলবে না তারা, এ আমার বিশ্বাস।
কেউ কেউ বলছেন নব্বই দশকে যখন কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ওপর অত্যাচার চলেছিল পাকিস্তান-পন্থী সন্ত্রাসীদের দ্বারা, তারা শুধু কাশ্মীরি হিন্দুদের নয়, সাধারণ কাশ্মীরি মুসলিম এবং শিখদেরও নির্যাতন করেছিল। লোকে এও বলছে, সে সময় ভারতের কেন্দ্রে বিজেপি সমর্থিত ভি পি সিংএর সরকার ছিলো ক্ষমতায়। তাঁরা কেন কাশ্মীরের হিন্দুদের উদবাস্তু হওয়া থেকে রক্ষা করেননি! কেউ কেউ এও বলেন, যাঁরা হিন্দু সমস্যা নিয়ে রাজনীতি করেন, তাঁরা চান না কাশ্মীরি হিন্দুরা কাশ্মীরে ফিরুক, আর যারা মুসলমান সমস্যা নিয়ে রাজনীতি করেন, তাঁরা চান না মুসলমানদের সমস্যা ঘুচে যাক। এই উপমহাদেশে হিন্দু মুসলমানে শান্তি কবে আসবে আমার জানা নেই।
দ্য কাশ্মীর ফাইলস দেখার পর বাংলাদেশ থেকে যে হিন্দুরা দেশ ত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গে বাস করতে বাধ্য হচ্ছে, তারা মিলিত হয়ে দ্য বাংলাদেশ ফাইলস নামে একটি অনুষ্ঠান করেছে। কাশ্মীর থেকে যে হিন্দুরা কাশ্মীর ত্যাগ করেছে বাংলাদেশ থেকে তার চেয়ে অনেক বেশি হিন্দু নিজের দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। তারপরও বাংলাদেশ ফাইলস নামে কাশ্মীর ফাইলসের মতো কোনও সিনেমা তৈরি হয়নি। বাঙালি পরিচালকদের এ নিয়ে উৎসাহ নেই।
কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ বলেছেন কাশ্মীরের হিন্দুবিরোধী জঙ্গি তৎপরতা কাশ্মীরের মসজিদগুলোয় শুরু হয়েছে। মসজিদেই হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের মনে ঘৃণা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, সন্ত্রাসে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। ওমর আবদুল্লাহ ভুল বলেননি। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সন্ত্রাসের ঘটনায় উপাসনালয়ের ভূমিকা যে বড়, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের মসজিদ মাদ্রাসায় নারী বিদ্বেষ, আর অমুসলিম-বিদ্বেষ অহরহই প্রচার করা হচ্ছে, এগুলোর লাগাম টেনে না ধরলে আনাচে কানাচে ঘটতে থাকবে হলি আর্টিজানের ঘটনা।
কাশ্মীর থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছে দু লক্ষ বা তিন লক্ষ কাশ্মীরি পণ্ডিত। তাদের অনেকে দাবি করেছেন বাংলাদেশ থেকে তো কোটি হিন্দু নিজের মাতৃভূমি ছেড়েছে বলে তাদের অনেকে দাবি করছে। কাশ্মীরি পণ্ডিতরা ভারতেই বাস করছেন, তাঁদের ঘরে ফেরার দাবির কথা সজোরে বলছেন, সরকারকে তাঁদের দাবি শুনতে হচ্ছে, সমস্যা সমাধানের কথা ভাবতে হচ্ছে। তারা বলছেন কিন্তু বাংলাদেশ থেকে হিন্দুরা যখন পালিয়ে ভারতে চলে যায়, তখন তারা তাদের ঘরে ফেরার দাবি করতে পারে না ভারত সরকারের কাছে। যেহেতু ভারত একটি ভিন্ন দেশ, ভারত তাদের ঘরে ফেরার দায়িত্ব নিতে পারে না। তাই উদবাস্তু বাঙালির ক্রন্দন মানুষের কানে খুব একটা যায় না।
সাধারণত দাঙ্গা লাগতে পারে, এমন কোনও বই, বা সিনেমা, বা লিফ্লেট বা বক্তৃতা ভারতে প্রচার করতে দেওয়া হয় না। দাঙ্গার ভয় সকলেরই আছে। সাতচল্লিশে দশ লক্ষ মানুষ মরেছিল। তারও আগে মরেছিল গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং-এ, সেসব আবার হতে দিতে কেউ চায় না। ভারতের সব সরকারই দাঙ্গা যেন না বাধে তার সব রকম ব্যবস্থা নেয়। শুনেছি গুজরাট দাঙ্গার ওপর করা কিছু ছবিকে আটকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কাশ্মীরের হিন্দু নিধনের গল্প যখন প্রকাশিত হলোই, তখন গুজরাটের মুসলিম নিধনের গল্পও প্রকাশিত হোক। সত্য প্রকাশ হওয়া জরুরি। এবং একই সঙ্গে দাঙ্গা যেন না বাধে তার সব রকম উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। মুখ বন্ধ করে, বই বা সিনেমা ব্যান করে এর সমাধান হবে না। সবাইকে সব ঘটনা জানতে হবে। তারপরই মানুষ প্রশ্ন করবে নিজেকে, তারা কি হিংসে আর ঘৃণা আরও ছড়িয়ে পড়ুক চায়? তারা কি ধ্বংস চায় নাকি শান্তি চায়? মুশকিল হলো, অধিকাংশ মানুষের চাওয়া বলতে কিছু নেই। রাজনীতিকরা যা চান, তা-ই তাদের চাওয়া।
হলোকস্টের ওপর প্রচুর সিনেমা তৈরি হয়েছে। কী করে ইহুদিদের নির্যাতন করেছিল নাৎসি বাহিনী, সেসব ছবি দেখে তা মানুষের জানা হয়েছে। ষাট লক্ষ ইহুদি মারা গিয়েছিল হিটলারের পরিকল্পিত ইহুদি-নিধনে। আমি লজ্জা নামে একটি তথ্যভিত্তিক উপন্যাস লিখেছিলাম ১৯৯৩ সালে। লজ্জায় আমি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুর ওপর কী ধরনের অত্যাচার হয়, এবং কেন হিন্দুরা দেশ ত্যাগ করে, সেসব বর্ণনা করেছি। বইটি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জার্মানীতে কি এখন নিষিদ্ধ করা হবে কী ভাবে ইহুদিদের অত্যাচার করেছিল নাৎসি বাহিনী? প্রশ্নই ওঠে না। বাংলাদেশে হিন্দুরা আজও দেশ ত্যাগ করে, আজও হিন্দুর দুঃখ কষ্ট নিয়ে লেখা বই নিষিদ্ধ হয়ে যায়। অনেকগুলো ভাষায় লজ্জা বইটির অনুবাদ বেরিয়েছে ভারতবর্ষে। তারপরও এটি নিয়ে সিনেমা হয়নি। দ্য কাশ্মীর ফাইলসের পর লজ্জা নিয়ে না হোক, বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু উদবাস্তুদের নিয়ে সিনেমা তৈরী হোক। তাদের মুখে তাদের গল্প শুনেও তো সিনেমা তৈরি করা যায়। দ্য কাশ্মীর ফাইলস বানানোর আগে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের অভিজ্ঞতা রেকর্ড করেছিলেন পরিচালক। আসামের দাঙ্গা নিয়েও সিনেমা হোক, সেখানে অসমীয়া হিন্দুরাই তো বাঙালি হিন্দুদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা করছে। অসন্তোষ কী আর শুধু হিন্দু মুসলমানের মধ্যে? বাঙালি-অবাঙালি হিন্দুর মধ্যেও প্রচুর, উঁচুশ্রেণি নিচুশ্রেণির যুদ্ধ তো বছরভর লেগেই আছে।
হিন্দুদের মধ্যে অনেকেই মনে করে হিন্দুরা ভারতবর্ষে একা থাকলেই সুখশান্তিতে থাকবে। মুসলিমরা কট্টর, মুসলিমরা দাঙ্গা সন্ত্রাস করে, মুসলিমরা মুসলিম দেশগুলোয় চলে যাক। কিন্তু হিন্দুরা কি হিন্দুদের সঙ্গে থাকলেই সমস্ত সমস্যার অবসান হবে? আমার মনে হয় না। হিন্দুদের উঁচুজাত নিচুজাতের যুদ্ধ তো শেষ হওয়ার নয়। মুসলিমদের শিয়া, সুন্নি, আহমদিয়া, প্রগতিশীল, কট্টর ইত্যাদির মধ্যে সংঘাত লেগেই আছে। ধর্ম অভিন্ন হলেই যে মানুষ মানুষের সঙ্গে সুখশান্তিতে বাস করতে পারে তা সত্য নয়। দৃষ্টিভঙ্গিতে যদি মিল থাকে, আদর্শ যদি অভিন্ন হয়, সভ্যতা আর সচেতনতার শিক্ষা যদি অর্জিত হয়, তবেই মানুষ হয়ে ওঠে পরস্পরের স্বজন।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা। সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন